সোফোক্লেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৭/৪৯৬, – খ্রিস্টপূর্ব ৪০৬/৪০৫)। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত তিনজন প্রাচীন গ্রিক নাট্যকারদের একজন, যাঁদের লেখা নাটক আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। অন্য দুইজন হলেন এসকাইলাস এবং ইউরিপিদেস। তার লিখিত বিভিন্ন ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্ত নাটক, যেমন ”আন্তিগনে” বা ”রাজা অয়দিপাউস” আজও মঞ্চে অভিনীত হয় এবং সারা পৃথিবীতেই এই নাটকগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এথেন্স নগর রাষ্ট্রে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর যে নাট্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত, প্রায় ৫০ বছর ধরে সেই প্রতিযোগিতায় বিয়োগান্ত নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তম স্থানটি ছিল তার জন্য বরাদ্দ। যদিও তিনি তার জীবদ্দশায় সম্ভবত ১২৩টি নাটক রচনা করেছিলেন, আমাদের হাতে তার মধ্যে মাত্র ৭টি পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এগুলি হল – ”আয়াক্স”, ”আন্তিগনে”, ”ত্রাখিসের মহিলারা”, ”রাজা অয়দিপাউস”, ”ইলেকট্রা”, ”ফিলোকতেতেস” ও ”কলোনাসে অয়দিপাউস”। এছাড়াও তার লেখা অনেকগুলি নাটকের কিছু কিছু অংশ পাওয়া গেছে। আঙ্গিক হিসেবে নাটকের বিকাশের ক্ষেত্রে সোফোক্লেসের অবদান অনস্বীকার্য। তার লেখা নাটকেই আমরা প্রথম কোনও তৃতীয় চরিত্রের দেখা পাই। তাছাড়া কোরাসের ভূমিকাও তিনি সংকুচিত করেন। তার লেখা নাটকে নাটকের ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে কোরাস তার আগের গুরুত্ব অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। নাটকে তার চরিত্রগুলিও অনেক বেশি বিকশিত। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘ ইডিপাস’ নাটকের মূল কাহিনীতে আমরা পাই থিবিসের রাজা লেয়াস। জোকাস্টা তার স্ত্রী। বহুদিন সন্তান না হওয়ার কারণ জানতে রাজা লেয়াস একাকী ডেলফির মন্দিরে যান। দৈববাণী শোনা গেল যে, তার এই সন্তান না হওয়ার দুর্ভাগ্যকে তার আশীর্বাদ মনে করা উচিত। কেননা জোকাস্টার গর্ভজাত এবং তার ঔরসজাত সন্তান কালে তার হত্যাকারী হবে। সে জোকাস্টাকে কোনো কথা জানাল না, বরং সে জোকাস্টা থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগল। জোকাস্টা তাকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে সন্তানবতী হলো। নয় মাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র লেয়াস ধাত্রীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক মেষপালকের হাতে দিল তাকে মারার জন্য মিথায়েরন পর্বতে। নবজাতকের পা দু’টো লোহার শিক দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো যাতে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পারে। কিন্তু নিয়তির নির্দেশে নবজাতকের মৃত্যু হলো না। পাশের রাজ্য করিন্থের এক মেষপালক তাকে কুড়িয়ে পেলো এবং তার নাম দিলো ইডিপাস। কেননা তার পা দু’টো পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করার ফলে ফুলে গিয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ইডিপাস শব্দের অর্থ পা ফোলা। মেষপালক তাকে করিনথে নিয়ে এলো। সে সময় রাজা পলিবাস করিনথে শাসন করছিলেন। রাজা পলিবাস ও রাণী মেরোপী নিঃসন্তান। তাই তারা ইডিপাসকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করতে লাগলো। একদিন ইডিপাস সন্দিগ্ধ হয়ে ডেলফির মন্দিরে গেল। দৈববাণীতে তার প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেল না, বরং বলা হলো যে, সে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং মাতাকে বিয়ে করবে। এটা তার নিয়তি। চরম হতাশা ও মর্মের বেদনায় বেদনার্ত ইডিপাস আর করিনথে ফিরে না গিয়ে ফোসিস নামে এক জনপদের কাছাকাছি একটা তে-রাস্তার মোড়ে এলো । সে সময় এক বৃদ্ধ রাজা কয়েকজন অনুচরসহ রথে করে যাচ্ছিলেন। ইডিপাসকে রাস্তা থেকে সরে যাবার হুকুম দেয়া হলো। ইডিপাস সরে না দাঁড়ালে রাজা রথ চালাবার হুকুম দিলেন। রথের একটি চাকা ইডিপাসের পা থেঁতলে দিলো এবং রেগে গিয়ে ইডিপাস রাজা এবং তার অনুচরদের হত্যা করলো। একজন মাত্র অনুচর কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গিয়ে থিবিসে জানাল যে, রাজা অনুচরসহ নিহত হয়েছেন দস্যুদের হাতে। ইডিপাস জানতেও পারলো না যে, দৈববাণীর প্রথম অংশ তার জীবনে ঘটে গেল। অর্থাৎ সে তার পিতাকে হত্যা করলো। রাজা লেয়াস ডেলফির মন্দিরে যাচ্ছিলেন এই জানার জন্যে যে, কী করে স্ফিংসের হাত থেকে থিবিবাসীকে রক্ষা করা যেতে পারে। সে সময় স্ফিংসের অত্যাচারে থিবিসবাসীর জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। একাকী পথচারীকে পেলে স্ফিংস একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করতো এবং উত্তর দিতে না পারলে তাকে হত্যা করতো । লেয়াসকে হত্যার পর ইডিপাস থিবিসের দিকে যাবার পথে নগরপ্রান্তে স্ফিংসের কবলে পড়ে। ধাঁধার উত্তর ইডিপাসের জানা ছিল। ধাঁধার উত্তর শুনে স্ফিংস পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। কেননা এটা হলো তার নিয়তি। স্ফিংসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে থিবিবাসী ইডিপাসকে রাজারূপে বরণ করে নিল। ইডিপাস রাজা হয়ে দেশাচার অনুযায়ী রাজার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করলো। কারণ সে তো জানতেই পারলো না লেয়াসের বিধবা স্ত্রী তার গর্ভধারিণী মা। এরপর সুদীর্ঘ পনেরোটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। থিবির প্রজারঞ্জক রাজা হিসেবে ইডিপাস পরম কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। পারিবারিক জীবনেও সে জোকাস্টাকে নিয়ে সুখী। তার চারটি সন্তান- দু’টি ছেলে, দু’টি মেয়ে। ইডিপাস জানতে পারেনি দৈববাণীর দ্বিতীয় অংশটিও তার জীবনে বহুপূর্বেই সফল হয়েছে। অর্থাৎ তারই গর্ভধারিণী তার শয্যাসঙ্গী হবে তা তার জীবনে নির্মমভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এটাই হলো ‘রাজা ইডিপাস’ নাটকের পূর্বসূত্র বা কাহিনী। এরপর থিবিস রাজ্যজুড়ে নেমে এলো মহামারী ও দুর্ভিক্ষ। মৃত্যুর অমানিশা। ভীত-সন্ত্রস্ত নগরবাসী এলো ইডিপাসের কাছে মুক্তির আশায়। এরপর আমরা ইডিপাসের যন্ত্রণাজর্জর জীবনের করুণ ট্র্যাজেডির স্বরূপ উদঘাটনে প্রয়াস পাবো। রাজ্যময় মহামারী আর দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নগরবাসী ইডিপাসের কাছে এলো। ইডিপাস প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশায় কাতর। সে রাজ্যশ্যালক ক্রিয়নকে এপোলোর মন্দিরে পাঠালো দেবতার নির্দেশ জানার জন্যে। ক্রিয়ন সবার সম্মুখে দৈববাণী জানাতে ইতস্তত করতে লাগলো। কিন্তু সে ইডিপাসের কথায় বললো, রাজ্যের মধ্যে এক মহাপাপকে লালন করা হচ্ছে। এ পাপ মোচন করতে পারলে রাজ্যে শান্তি ফিরে আসবে। কী সেই পাপ? এবং ইডিপাস কীভাবে জানতে পারে এই পাপের কাহিনী? এবং জানার পর ইডিপাস কোন পরিণতির মুখোমুখি হয় তা জানতে পারবেন পুরো নাটকটি পড়লে বা দেখলে।